ইউসুফ বিন তাশফীন – ইমরান রাইহান

১২ রজব ৪৭৯ হিজরী।

২৩ অক্টোবর, ১০৮৬ খ্রিস্টাব্দ। শুক্রবার। বাদ ফজর। যাল্লাকা ময়দান।

বাতাস এখানে স্থির হয়ে আছে। ভ্যপসা গরম লাগছে। ইউসুফ বিন তাশফিন, মুরাবিতীনদের আমীর, কপালের ঘাম মুছলেন। ঘামের সাথে ধূলি মিশে চটচটে হয়ে গেছে। টিলার ওপাড়ে ধূলি উড়ছে। এতদূর থেকে শব্দ শোনা যাওয়ার কথা নয়, তবু ভালোভাবে কান পাতলে অস্ত্রের ঝনঝনানি ও যোদ্ধাদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। টিলার ওপাড়ে, মুতামিদ বিন আব্বাদের বাহিনী লড়ছে ষষ্ঠ আলফোন্সোর বিরুদ্ধে। মুতামিদ বিন আব্বাদের বাহিনীর সাথে আছে ছোট একটি মুরাবিত বাহিনী। মুরাবিতদের মূল দল নিয়ে ইউসুফ বিন তাশফিন অপেক্ষা করছেন টিলার এপাশে। তিনি মাঠে নামবেন, যখন দুই বাহিনী লড়াই করে ক্লান্তির সীমানায় পৌছে যাবে তখন। তার বাহিনী পূর্ণ উদ্যমে হামলা চালাবে ষষ্ঠ আলফোন্সোর বাহিনীর উপর।

ইউসুফ বিন তাশফিন নিজের বাহিনীর দিকে তাকালেন। সৈন্যরা ঘোড়ার পিঠে বসে আছে। দুয়েকজন একত্র হয়ে গল্প করছে কিংবা অলস দৃষ্টিতে টিলার ওপাড়ে তাকিয়ে আছে। ইউসুফ বিন তাশফিন জানেন সামান্য ইংগিতে এই সৈন্যরা ক্ষিপ্র চিতার মত হামলে পড়বে শত্রুর ওপর। নাকে বসা একটা মাছি তাড়াতে গিয়ে ইউসুফ বিন তাশফীন আনমনা হয়ে গেলেন।

বড় ছেলের কথা মনে পড়লো। আসার সময় দেখেছিলেন ছেলে অসুস্থ, শয্যাশায়ী। জানা নেই ছেলে এখন কেমন আছে। টিলার ওপাশে তাকাতে তাকাতে ইউসুফ বিন তাশফিন ভাবলেন, চাইলে তিনি এখন মরক্কো থাকতেন। দীর্ঘ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এই অচেনা দেশে নিজের সৈন্যদের ঝুকিতে ফেলার কোনো দরকারই ছিল না। কিন্তু চাইলেই কী তিনি এ যাত্রা এড়িয়ে যেতে পারতেন? তাকে তো আসতেই হতো আন্দালুসে। মুসলিম ভাইদের আহবানে সাড়া দিতেই হতো। এছাড়া উপায় ছিল না।

ইউসুফ বিন তাশফিনের মনে পড়ে ৫ বছর আগের কথা। ৪৭৪ হিজরীতে প্রথম আন্দালুস থেকে আগত একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাত করে আন্দালুসের বিভিন্ন সমস্যার কথা জানায়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল পার্শ্ববর্তী খ্রিস্টান রাষ্ট্র কর্তৃক মুসলিম আন্দালুসে হামলা ও নির্যাতনের কথা। ইউসুফ বিন তাশফিন আগ থেকেই আন্দালুসের খোজখবর রাখছিলেন।

তিনি জানতেন ৪২২ হিজরীতে কর্ডোভায় খেলাফতে উমাইয়ার পতনের পর থেকে আন্দালুস হয়ে উঠেছে বিভক্ত কিছু রাজ্যের সমষ্টি। রাজত্ব আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়ে মুসলিমরা লড়ছে একে অপরের বিরুদ্ধে। ভাইয়ের রক্তে ভাইয়ের হাত রঞ্জিত হচ্ছে। আর এই সুযোগ নিচ্ছে পার্শ্ববর্তী খ্রিস্টান রাজ্য। খ্রিস্টান সম্রাট ফার্ডিন্যান্ড কয়েকটি মুসলিম রাজ্য দখল করেন। তারপর ক্ষমতায় আসে ষষ্ঠ আলফোন্সো।

৪৭৮ হিজরীতে ষষ্ঠ আলফোন্সোর হাতে পতন হয় টলেডোর। এরপর আর কখনই টলেডো ইসলামী সাম্রাজ্যের আওতায় আসেনি। টলেডোর পর আলফোন্সো সেভিল অবরোধ করেন। এ সময় সেভিলের শাসক মুতামিদের সাথে তার পত্র চালাচালি হয়। মুতামিদ ছিলেন আত্মমর্যাদায় বলিয়ান একজন শাসক। চাইলেই তিনি অন্য মুসলিম রাজ্যগুলোর মত কর দিয়ে আলফোন্সোর বশ্যতা স্বীকার করতে পারতেন।

কিন্তু তিনি আলফোন্সোর প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। অবরোধ চলতে থাকে। আলফোন্সো মুতামিদের কাছে পত্র লিখে বলে, অবরোধ দীর্ঘ হচ্ছে। এখানে খুব গরম, আর মাছির বেশ উপদ্রব। আমার জন্য একটি পাখা পাঠাও। যেন বাতাসে জিরোতে পারি আর মাছি তাড়াতে পারি।

আলফোন্সো বুঝাতে চাচ্ছিল অবরোধ করতে তার আপত্তি নাই। মুসলিম বাহিনী নিয়েও সে চিন্তিত নয়। বরং এ মুহূর্তে মাছিই তাকে বেশি পেরেশান করছে। মুতামিদ এ পত্র পেয়ে পত্রের উলটো পিঠে লিখে দিলেন, তোমার পত্র পেয়েছি। শীঘ্রই আমি তোমার জন্য লামতি চামড়ার পাখা পাঠাবো। এ পাখা থাকবে মুরাবিতী সেনাদের হাতে। এ পাখার বাতাস আমাদেরকে তোমার হাত থেকে স্বস্তি দিবে কিন্তু তোমাকে কোনো স্বস্তি দিবে না।


মুতামিদ বিন আব্বাদ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি মুরাবিতিনদের সাহায্য চাইবেন। মুরাবিতীনরা তখন উত্তর আফ্রিকা শাসন করছে। তাদের আমীর ইউসুফ বিন তাশফিন। তার শৌর্যবীর্যের গল্প শোনা যায় আন্দালুস থেকেও। মুতামিদ বিন আব্বাদ সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি ইউসুফ বিন তাশফিনকে পত্র লিখবেন।

তাকে বলবেন, একবার অন্তত আন্দালুসে এসে মুসলিম ভাইদের সাহায্য করতে। মুতামিদ তার সভাসদদের নিজের সিদ্ধান্ত জানালেন। কেউ কেউ তার সিদ্ধান্ত স্বাগত জানালেও অনেকে প্রতিবাদ করলো। বিশেষ করে বিভক্ত রাজ্যসমূহের শাসকরা তার সিদ্ধান্ত শুনে নাখোশ হলো। তারা বারবার তার সাতেহ দেখা করে তাকে বুঝাচ্ছিল, তিনি যেন ইউসুফ বিন তাশফিনের সাহায্য না চান।

তারা বলছিল, ইউসুফ বিন তাশফিন হয়তো আপনাকে সাহায্য করবেন, কিন্তু একইসাথে তিনি আপনাকে রাজ্য ছাড়া করে নিজেই এ রাজ্য করায়ত্ত করবেন। এসব কথার জবাবে মুতামিদ বিন আব্বাদ যা বলেছিলেন তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্নাক্ষরে লেখা আছে। তিনি বলেছিলেন, শূকরের রাখাল হওয়ার চাইতে উট চড়ানো ভালো। অর্থাৎ আলফোন্সোর হাতে বন্দী হয়ে শূকর চড়ানোর চাইতে ইউসুফ বিন তাশফিনের গোলাম হয়ে উত্তর আফ্রিকায় উট চড়ানো উত্তম।

শাসকদের মধ্যে গ্রানাডার শাসক আবদুল্লাহ বিন বুলুক্কিন ও বাতালইয়ুস শাসক মুতাওয়াক্কিল বিন আফতাস, মুতামিদের সাথে একমত হন। ফলে সিদ্ধান্ত হলো গ্রান্ডা, সেভিল ও বাতালইয়ুস একত্রে মুরাবিতিন আমিরের কাছে সাহায্য চাইবে। মুতামিদ এবার প্রতিনিধিদল গঠন করেন।

এই দলে ছিলেন গ্রানাডার বিচারক আবু জাফর কালিয়ী, কর্ডোভার বিচারক আবু বকর বিন আদহাম, বাতলইয়ুসের বিচারক আবু ইসহাক বিন মুকানা। এই প্রতিনিধিদলের চতুর্থ সদস্য ছিলেন মুতামিদের উযির আবু বকর বিন যাইদুন। তিন বিচারকের দায়িত্ব ছিল তারা ইউসুফ বিন তাশফিনের সাথে আলোচনা করবেন। আর উযিরের দায়িত্ব ছিল কোনো চুক্তি করতে হলে তিনি তা সম্পাদন করবেন।

৪৭৮ হিজরীতে এই প্রতিনিধিদল ইউসুফ বিন তাশফিনের সাথে সাক্ষাত করে। তিনি মনোযোগ দিয়ে তাদের কথা শুনেন। ইউসুফ বিন তাশফিন তো আগ থেকেই ভাবছিলেন আন্দালুসের ভাইদের সাহায্য করার কথা। অভিযান নির্বিঘ্ন করার জন্যই তিনি সাক্কুত বারগুয়ারির হাত থেকে সিউটা নৌবন্দর দখল করেন।

তিনি অপেক্ষায় ছিলেন সেভিল কিংবা গ্রানাডা থেকে কোনো বার্তা আসে কিনা। কারন এই দুই রাজ্য অতিক্রম করা ছাড়া আন্দালুসে প্রবেশের উপায় ছিল না। এখন মুতামিদ বিন আব্বাদের প্রতিনিধিদল আসায় ইউসুফ বিন তাশফিনের কাজ সহজ হয়ে গেল। ইউসুফ বিন তাশফিন প্রতিনিধিদলকে কথা দেন শীঘ্রই তিনি আন্দালুস আসবেন।

রোদের তেজ বেড়েছে। চোখের উপর হাত দিয়ে সামনে তাকাতে হয়। ধুলি উড়া দেখে বোঝা যায় যুদ্ধক্ষেত্র বিস্তৃত হচ্ছে। যোদ্ধারা ছড়িয়ে পড়ছে।

ইউসুফ বিন তাশফিন আরো একবার অতীতে ফিরে তাকান।তার মনে পড়ে মুতামিদের প্রতিনিধিদল কে বিদায় জানিয়েই তিনি যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেন। বড় ছেলে তখন খুবই অসুস্থ। কিন্তু তবুও তিনি বিলম্ব করতে চাইছিলেন না। তার কানে ভেসে আসছিল আন্দালুসের মুসলমানদের আহবান। বারবার মনে পড়ছিল টলেডোর কথা। তিনি চাচ্ছিলেন না সেভিলের ভাগ্যেও নেমে আসুক টলেডোর সেই বিপর্যয়। ইতিমধ্যে আলফোন্সো তার আন্দালুস আগমনের সংবাদ পেয়ে দম্ভে ভরা একটি দীর্ঘ পত্র লিখে৷ পত্রের ভাষ্য ছিল,

……আপনাদের ধারনা, আল্লাহ আমাদের দশজনের বিরুদ্ধে আপনাদের একজনকে লড়তে বলেছেন। যান এটা আরো সহজ করে দিলাম। এখন আমাদের একজনের বিরুদ্ধে আপনাদের দশজন লড়লেই হবে।
…. শুনলাম আপনি নাকি সাগর পাড়ি দিতে পারছেন না। এক কাজ করুন। আমার জন্য কিছু নৌকা পাঠিয়ে দিন। আমি সমুদ্র অতিক্রম করে আপনার দেশে আসবো। তারপর আপনার পছন্দসই কোনো স্থানে আপনার সাথে লড়বো।

ইউসুফ বিন তাশফিন এই পত্রের কোনো জবাব না দিয়ে নিজের বাহিনী প্রস্তুতে মন দিলেন। অবশেষে তিনি আন্দালুসের পথ ধরেন। জিব্রাল্টার প্রনালী অতিক্রমকালে মুরাবিতদের বহনাকারী জাহাজগুলো সামদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়ে। ইউসুফ বিন তাশফিন তখন হাত তুলে মুনাজাত ধরেন৷ তিনি দোয়ায় বলেন, হে আল্লাহ, যদি আমাদের এ সমুদ্র যাত্রায় মুসলমানদের কোনো কল্যাণ থাকে তাহলে এই সফর আমাদের জন্য সহজ করে দিন৷ আর যদি এতে কোনো কল্যান না থাকে তাহলে আমাদের জন্য এ সফর কঠিন করে দিন।

এই দোয়ার কিছুক্ষণ পর সমুদ্র শান্ত হয়ে যায়৷ ইউসুফ বিন তাশফিনের বাহিনী নিরাপদে সমুদ্র পাড়ি দেয়। আন্দালুসে পা রেখে ইউসুফ বিন তাশফিন সেজদায়ে শোকর আদায় করেন।

আন্দালুস নেমে ইউসুফ বিন তাশফিন সেভিলের পথ ধরেন৷ এ সময় আন্দালুসের মুসলমানরা তাকে স্বাগত জানায়। সেভিল থেকে তিনি বাতালইয়ুসের দিকে যাত্রা করেন৷ কারন ষষ্ঠ আলফোন্সো মুসলিম বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য যে যাল্লাকা ময়দানে শিবির স্থাপন করেছে তা বাতালইয়ুসের নিকটেই। পথে মুতামিদের সাথে সাক্ষাত হয়। মুতামিদ ছোট একটি বাহিনী নিয়ে এসেছেন। এছাড়া কর্ডোভা, সেভিল ও বাতালইয়ুস থেকে এসেছে স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধারা৷ এভাবে ইউসুফ বিন তাশফিনের সেনা সংখ্যা পৌছালো ত্রিশ হাজারে।

এবার ইউসুফ বিন তাশফিন আলফোন্সোর জবাব দিলেন। তিনি লিখলেন, তুমি সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমার সাথে লড়তে চেয়েছিলে। এখন আমিই তোমার কাছে চলে এসেছি। অপেক্ষা করো শীঘ্রই কোনো ময়দানে আমরা মুখোমুখি হবো।

এরপর তিনি আলফোন্সোকে ইসলাম গ্রহণ, জিযিয়া আদায় অথবা যুদ্ধ তিনটির কোনো একটি বেছে নিতে বলেন। এই পত্র পেয়ে আলফোন্সো রেগে যায়। আশি বছর ধরে তারা আন্দালুসের মুসলমানদের থেকে জিযিয়া আদায় করছে, আজ কেউ তাকে শক্ত চ্যালেঞ্জ করলো।

‘আমি যুদ্ধ বেছে নিলাম। তুমি কী ভাবছো?’ ফিরতি জবাব্ব লিখলো আলফোন্সো।

‘আমার জবাব তুমি চোখের সামনে দেখবে’ লিখলেন ইউসুফ বিন তাশফিন৷

ইউসুফ বিন তাশফিনের আগমনের সংবাদ পেয়েই আলফোন্সো তার পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। দলে দলে সৈন্য যোগদান করে তার বাহিনীতে। পাদ্রী ও বিশপরা সাধারণ জনতাকে যুদ্ধের জন্য উত্তেজিত করতে থাকেন। এভাবে তার বাহিনী বিশালাকার ধারণ করে। ঐতিহাসিকদের মতে যাল্লাকার ময়দানে আলফোন্সোর সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় তিন লাখ, যা কিনা মুসলিম বাহিনীর চেয়ে দশগুন বেশি।

আলফোন্সো মুসলিম বাহিনীকে ধোকা দেয়ার জন্য যুদ্ধের দিন নির্ধারণ করে দেয়। আলফোন্সো তার এক বার্তায় জানায়, আগামীকাল শুক্রবার। এদিন আপনাদের সাপ্তাহিক আনন্দের দিন। তাই এদিন লড়া ঠিক হবে না। পরদিন শনিবার। এদিন ইহুদিদের সাপ্তাহিক আনন্দের দিন। সেদিনও লড়া যাবে না। এরপর দিন রবিবার। আমাদের সাপ্তাহিক ধর্মীয় আচার পালনের দিন। তাই আমার মনে হয় সোমবারে আমাদের লড়াই হলেই ভালো।
এই বার্তা পেয়ে ইউসুফ বিন তাশফিন সোমবারের যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হন।

‘এটা হতো ভুল সিদ্ধান্ত’ নিজের সেনাদের দিকে তাকিয়ে ভাবলেন ইউসুফ বিন তাশফিন। তিনি আলফোন্সোর ধূর্ততা ধরতে পারেননি। তিনি ভেবেছিলেন সোমবারেই যুদ্ধ হবে। কিন্তু মুতামিদ বিন আব্বাদ আলফোন্সোর চাল ধরে ফেলেন। তিনি ইউসুফ বিন তাশফিনকে সতর্ক করেন। তিনি বলেন, আলফোন্সো সম্ভবত শুক্রবারেই হামলা করবে। একথা শুনে ইউসুফ বিন তাশফিন সতর্ক হন। নিজের সেনাপতিদেরকেও সতর্ক করে রাখেন।

‘সতর্ক না হলে আজকের যুদ্ধ কঠিন হতো’ ঘোড়ার কেশরে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবলেন ইউসুফ বিন তাশফিন। গত বছর হিময়ার গোত্রের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কিনেছেন ঘোড়াটি। গতরাতে খুব একটা ঘুমানোর সুযোগ হয়নি। সারারাত নফল ও মুনাজাত আদায় চলেছে। ফকিহরা সেনাদেরকে বারবার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পলায়নের শাস্তির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন।

ঘোড়ার হ্রেষা ডাক শোনা যায়। ইউসুফ বিন তাশফিন ফিরে তাকালেন। একটু দূরে আবুল আব্বাস আহমাদ বিন রুমাইলাকে দেখা যাচ্ছে। ইউসুফ বিন তাশফিনের চেহারায় মুচকি হাসি ফুটে ওঠে। তার মনে পড়ে সকালেই ইবনে রুমাইলা তাকে একটি স্বপ্নের কথা শুনিয়েছেন।

গতরাতে ইবনে রুমাইলা স্বপ্নে দেখেছেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বলেছেন, ইবনে রুমাইলা, তোমরাই বিজয়ী হবে এবং তুমি আমার সাথে মিলিত হবে। ইউসুফ বিন তাশফিন আরো একবার আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে ওঠেন। এই স্বপ্ন সুসংবাদ। ইনশাআল্লাহ, আজ বিজয় মুসলমানদেরই হবে।

তবে এখনো বিজয়ের কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। মুতামিদ বিন আব্বাদের বাহিনী লড়ে চলছে আলফোন্সোর বাহিনীর বিরুদ্ধে। মুতামিদের কথামত ইউসুফ বিন তাশফিন আজকের লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। তিনি বাহিনীকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছিলেন। আন্দালুসের যোদ্ধারা থাকবে মুতামিদ বিন আব্বাদের নেতৃত্বে, রনাংগনের সামনের দিকে। তাদের সাথে থাকবে দাউদ বিন আয়েশার নেতৃত্বে মুরাবিতদের ছোট একটি বাহিনী।

মূল বাহিনী নিয়ে ইউসুফ বিন তাশফিন টিলার আড়ালে লুকিয়ে থাকবেন। এটি একটি যুদ্ধ কৌশল, যা ইউসুফ বিন তাশফিন ইতিহাস থেকে শিখেছেন। ইতিপূর্বে খালিদ ইবনে ওয়ালিদ (রা) ওয়ালাজার যুদ্ধে এই কৌশল অবলম্বন করেছিলেন।

এছাড়া নোমান বিন মুকাররিনও নিহাওয়ান্দের যুদ্ধে এই কৌশল অবলম্বন করে সাফল্য অর্জন করেন। গতরাতেই সেনাদের এভাবে সাজানো হয়। আশংকা ছিল সকালেই হয়তো আলফোন্সো ওয়াদা ভংগ করে হামলা চালাবে। আর বাস্তবে তাই হলো। সকালেই আলফোন্সো তার বাহিনী নিয়ে মুসলিম বাহিনীর উপর হামলে পড়ে।

টিলার আড়াল থেকে ইউসুফ বিন তাশফিন যুদ্ধের খবর রাখছিলেন। প্রথম থেকেই মুসলিম বাহিনী বীরত্বের সাথে লড়াই করে। কিন্তু আলফোন্সো তার সেনাধিক্যের কারনে এগিয়ে যায়। অনেক মুসলিম সেনা নিহত হন। এমনকি সেনাপতি মুতামিদও আহত হন। তিনবার তার ঘোড়া মারা যায়। খ্রিস্টান সেনারা মুসলিম বাহিনীর রক্ষনব্যুহ ভেংগে ফেলে।

মুসলিম সেনারা দৃঢ় থাকা সত্ত্বেও বিজয়ের পাল্লা খ্রিস্টান বাহিনীর দিকে ঝুকে পড়ে। ইউসুফ বিন তাশফিন বুঝলেন এখনই সময়। এখুনি খ্রিস্টান বাহিনীর উপর হামলা করতে হবে। তিনি নিজের কাছে থাকা বাহিনীকে দু ভাগ করলেন। সায়র বিন আবু বকরের নেতৃত্বে একটি দলকে পাঠালেন মুতামিদের বাহিনীকে সাহায্য করতে। অন্য দলটি নিয়ে তিনি ঘুরে ময়দানের শেষ দিকে চলে গেলেন। এখানেই আলফোন্সোর শিবির। সারী সারী তাবু। ভেতরে আলফোন্সোর বাহিনীর রসদ। শিবিরের প্রহরায় সামান্য কজন সৈন্য।

ইউসুফ বিন তাশফিনের জোরালো হামলায় তারা খড়কুটোর মতই ভেসে গেল। যারা বেচে গেল তারা প্রতিরধের পরিবর্তে পালিয়ে আলফোন্সোর বাহিনীর দিকে গেল। ইউসুফ বিন তাশফিন তাবুতে আগুন ধরিরে দিলেন। জ্বলতে থাকে আলফোন্সোর বাহিনীর রসদ৷ আগুনের লোলিহান শিখা জ্বলে ওঠে আলফোন্সোর শিবিরে। মুখে আগুনের উত্তাপ অনুভব করেন ইউসুফ বিন তাশফিন৷ নিজের বাহিনীকে এবার তিনি ময়দানের দিকে ঘুরিয়ে দেন৷

এদিকে আলফোন্সোর শিবিরের পলাতক প্রহরীরা তাকে শিবিরে হামলার কথা জানায়। আলফোন্সো তার বাহিনীর একাংশকে শিবিরের দিকে প্রেরণ করে। এই বাহিনী শিবিরের দিকে যাওয়ার আগেই ইউসুফ বিন তাশফিন তাদের উপর হামলে পড়েন৷ খ্রিস্টান বাহিনী এখন দুদিক থেকেই হামলার মুখোমুখি৷ তীব্র লড়াই হয়। দুপক্ষের যোদ্ধারা বীরত্বের সাথে লড়তে থাকে।

৭৯ বছর বয়সী ইউসুফ বিন তাশফিনও একজন সাধারণ যোদ্ধার মতই লড়েন৷ জয়ের পাল্লা স্থির হয়ে যায়। সন্ধ্যা পর্যন্ত একটানা লড়াই চলে। অবশেষে খ্রিস্টান বাহিনী পরাজিত হয়। একের পর এক খ্রিস্টান সেনার লাশ মাটিতে লুটিয়ে পড়তে থাকে৷ খ্রিস্টান বাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়৷ আলফোন্সো তার একান্ত সহচরদের সাথে পালাতে থাকে।

ইউসুফ বিন তাশফিন তার নেতৃত্বে থাকা সুদানী বাহিনীকে ইশারা দেন আলফোন্সোকে ধাওয়া করতে৷ এই বাহিনী আলফোন্সোর বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে। তুমুল লড়াই চলে। এ সময় ওক যোদ্ধার নিক্ষিপ্ত বর্শা আলফোন্সোর উরু ভেদ করে৷ আলফোন্সো মারাত্মক আহত হয়ে পলায়ন করে। এই আঘাতের ফলে সারাজীবন তাকে খুড়িয়ে চলতে হত। আলফোন্সো তার ৫০০ সেনাসহ পালিয়ে যায়।

এসময় মুতামিদের সাথে ইউসুফ বিন তাশফিনের মতের অমিল হয়। মুতামিদ চাচ্ছিলেন আলফোন্সোকে ধাওয়া করে হত্যা করতে। ইউসুফ বিন তাশফিনের বক্তব্য ছিল সারাদিনের যুদ্ধে মুসলিমরা ক্লান্ত। আর আলফোন্সোর দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সে হয়তো নির্মমভাবে রুখে দাঁড়াবে। তাই তিনি ধাওয়া করতে চাচ্ছিলেন না। এভাবেই আলফোন্সো পালিয়ে যায়। আন্দালুসের পরবর্তী ইতিহাসের দিকে তাকালে মুতামিদের সিদ্ধান্তই সঠিক মনে হয়।

যুদ্ধলব্ধ সম্পদ একত্রিত করা হয়। প্রচুর গণিমত অর্জিত হয়। গণিমত ভাগের সময় মুরাবিতদেরকেও একটি ভাগ দেয়ার কথা হয়। ইউসুফ বিন তাশফিন সাফ জানিয়ে দেন, তিনি গণিমত নিবেন না৷ ৭৯ বছর বয়সে দীর্ঘ সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এই অভিযানে তিনি গণিমতের জন্য আসেন নি। তিনি এসেছেন মুসলিম ভাইদের সাহায্য করতে। জিহাদের ফজিলত অর্জন করতে। তিনি এর প্রতিদান চান আল্লাহর কাছে। তাই তিনি পার্থিব কিছুই গ্রহণ করবেন না।

ইউসুফ বিন তাশফিন গণিমতের ভাগ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন।
ইতিমধ্যে মরক্কো থেকে সংবাদ আসে ইউসুফ বিন তাশফিনের বড় ছেলে ইন্তেকাল করেছেন। এ সংবাদে ইউসুফ বিন তাশফিন ব্যথিত হন। তিনি সেনাবাহিনী সহ মরক্কো ফিরে যান। এদিকে আন্দালুসের প্রতিটি মসজিদের মিম্বর থেকে তখন ইউসুফ বিন তাশফিনের জন্য দোয়া করা হচ্ছে।

এক সহস্রাব্দ দূরে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের এক নগন্য পাঠক যখন ভাবে ইউসুফ বিন তাশফিনের কথা, তখন তার কীর্তিগাথা বিস্ময়কর মনে হয়। ৭৯ বছর বয়সে তিনি দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি উপেক্ষা করে ছুটে এসেছিলেন আন্দালুসে, কোনো পার্থিব স্বার্থ ছাড়া। কেবলই ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধের জায়গা থেকে। তার কারনেই আন্দালুসে মুসলিম শাসন টিকে ছিল আরো কয়েক শতাব্দী। যাল্লাকার যুদ্ধের পর আরো দুবার তিনি আন্দালুসে গমন করেন।

৪৮১ হিজরীতে দ্বিতীয়বার, ৪৮৩ হিজরীতে তৃতীয়বার। তিনি চাচ্ছিলেন মুসলিম শাসকদের সাহায্য করতে, মুসলিম শাসন টিকিয়ে রাখতে। কিন্তু মুসলিম শাসকরা নিজেদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বে ক্রমেই দূর্বল হচ্ছিল, এমনকি তারা একে অপরের বিরুদ্ধে গোপনে হাত মিলাচ্ছিল খ্রিস্টানদের সাথে। এমনকি ইউসুফ বিন তাশফিনের হাতে এমন একটি পত্র আসে যাতে একজন মুসলিম শাসক ইউসুফ বিন তাশফিনের সাথে লড়াই করার জন্য খ্রিস্টানদের সাহায্য চেয়েছিল। এসব তিনি ইউসুফ বিন তাশফিন অত্যন্ত ব্যথিত হন। এতদিন তার রাজ্যজয়ের কোনো চিন্তা ছিল না।

কিন্তু এবার মনে হলো আন্দালুসের মুসলমানদের কল্যানের জন্যই এইসব অথর্ব শাসকদের হটানোর কোন বিকল্প নাই। তাই ৪৮৩ হিজরীতে ইউসুফ বিন তাশফিনের অভিযান ছিল রাজ্যজয়ের অভিযান। একেরপর পর এক আন্দালুসের শহরগুলো দখল করে নেন তিনি।

একে মুরাবিতি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। তবে এ হামলার আগে তিনি আলেমদের কাছে পত্র লিখে আন্দালুসের বিস্তারিত অবস্থা জানান এবং হামলা চালানোর ব্যাপারে ফতোয়া জানতে চান। আলেমরা সবাই তাকে হামলা চালানোর বৈধতা দেন। যারা তাকে হামলা চালানোর বৈধতা দিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন বাগদাদের একজন আলেম, ইতিহাস যাকে চেনে ইমাম গাজালি নামে।

ইউসুফ বিন তাশফিনের জন্ম ৪০০ হিজরীতে। ৪৫৩ হিজরীতে তিনি উত্তর সেনেগাল ও দক্ষিণ মৌরিতানিয়ার দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি মরক্কো, আলজেরিয়া, তিউনেসিয়া, পুরো সেনেগাল ও পুরো মৌরিতানিয়া কব্জা করে নেন। ৪৬৮ হিজরীতে দেখা যায় তার দলে অশ্বারোহী সেনা সংখ্যাই এক লক্ষ।

ততদিনে তিনি প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন মারাকিশ শহর। নিজের জন্য তিনি বেছে নেন আমিরুল মুসলিমীন উপাধি। নিজেকে পরিচয় দিতেন বাগদাদের খলিফার একজন নগন্য কর্মচারী বলে। অথচ ততদিনে বাগদাদের দূর্বল আব্বাসী সাম্রাজ্য থেকে মুরাবিতি সাম্রাজ্য হাজারগুন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তার সাম্রাজ্যের প্রায় দুহাজার মসজিদে আব্বাসী খলিফার নামে খুতবা পাঠ করা হতো। ইউসুফ বিন তাশফিন ইন্তেকাল করেন ৫০০ হিজরীতে, ১০০ বছর বয়সে।


তথ্যসূত্র :

১. কিসসাতু আন্দালুস – ড. রাগেব সিরজানি
২. নাফহুত তিব– আল্লামা মাক্কারি