খতীবে ইসলামঃ মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকি

১৮ জানুয়ারী ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ। সেশন কোর্ট চত্বর, লাহোর। দুপুর বারোটা।

বিষ্ফোরণের প্রথম ধাক্কাটা কেটে গেছে। চারপাশে বিরাজ করছে অদ্ভুত নীরবতা। মাওলানা আযম তারিক, সিপাহে সাহাবার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা, উপুড় হয়ে পড়ে আছেন কোর্টের চত্বরে। তার মাথা ঝিমঝিম করছে, কানে তালা লেগে গেছে। বিস্ফোরণের পর কয়েক মিনিটের জন্য জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি। ‘আমাদের উপর আক্রমণ করা হয়েছে’ ভাবলেন মাওলানা আযম তারিক। অনেক কষ্টে উঠে বসলেন তিনি। বাতাসে এখনো সাদা ধোঁয়া উড়ছে। আশপাশে অনেক মানুষের লাশ পড়ে আছে। একটু দুরেই দেখা যাচ্ছে সিপাহে সাহাবার প্রধান মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকি উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। আযম তারিক নিজের দিকে তাকালেন। পায়ের বুটজোড়া বোমার আঘাতে উড়ে গেছে। বাম পায়ের কনিষ্ঠ আঙ্গুল চামড়ার সাথে লটকে আছে। হাটুর নিচে পাজামা গায়েব, সেখানে অঝোর ধারায় রক্ত ঝরছে। দুই হাতও রক্তাক্ত। পেটের অংশে জামা ছিঁড়ে গেছে। চামড়ায় ছোপ ছোপ রক্ত। শোরগোল শোনা যাচ্ছে।

‘কায়েদিন, কায়েদিন’ বলে চিৎকার করছে কারা যেন। ‘ওরা সিপাহে সাহাবার কর্মী’ মনে মনে ভাবলেন আযম তারিক। চেষ্টা করলেন জিয়াউর রহমান ফারুকির দিকে এগিয়ে যেতে। দূর্বল শরির সায় দিল না, মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। ইতিমধ্যে সিপাহে সাহাবার কর্মীরা ছুটে এসেছে। মাওলানা আযম তারিককে ধরাধরি করে গাড়িতে তোলা হলো। অন্য গাড়িতে তোলা হলো জিয়াউর রহমান ফারুকিকে। হাসপাতালে পৌঁছতেই মাওলানা আযম তারিককে জরুরী বিভাগে নিয়ে আসা হয়। ডাক্তাররা জানান দ্রুত অপারেশন করতে হবে। মাওলানাকে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে আসা হয়। 

মাওলানা আযম তারিক বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন, ফারুকি সাহেবের কী অবস্থা? উনি কেমন আছে। 
‘তিনি সামান্য আঘাত পেয়েছেন। দ্রুতই সেরে যাবেন’ এই বলে তাকে সান্ত্বনা দেয়া হয়।

‘ফারুকি সাহেব চলে আসবেন। আমরা আবার পাশাপাশি বসে কথা বলবো’ ভাবলেন মাওলানা আযম তারিক।

অপারেশন শেষ হলো। মাওলানা আযম তারিক বলেন, আমাকে ফারুকি সাহেবের কাছে নিয়ে চলুন। একটু পরে নেয়া হবে, এই বলে ডাক্তাররা চলে যান। কয়েক ঘন্টা পার হয়। মাওলানা আযম তারিক অধৈর্য হয়ে উঠেন। তিনি বারবার বলেন, আমি ফারুকি সাহেবের কাছে যাব। উপস্থিত একজন এগিয়ে এসে আযম তারিকের মুখ দুহাতে আঁকড়ে ধরে। অশ্রুভেজা কন্ঠে বলে উঠে, ‘মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকি শহিদ হয়ে গেছেন। হাসপাতালে আনার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেছেন’


মাওলানা আযম তারিকের শারিরিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য করে তাকে মাওলানা ফারুকির মৃত্যুসংবাদ জানাতে বিলম্ব করা হয়েছিল। কিন্তু এর আগেই পুরো পাকিস্তান জেনে গেছে সিপাহে সাহাবার প্রধান মুওয়াররিখে ইসলাম মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকি বোমা বিস্ফোরণে শহিদ হয়ে গেছেন। এই হামলায় নিহত হয়েছে আরো ২৬ জন।

এই সংবাদ জেনে গেছেন মক্কা শরিফে অবস্থানরত শায়খ মুহাম্মদ মক্কিও। মসজিদে হারামের চত্বরে অশ্রুসজল চোখে বসে আছেন তিনি। একের পর এক স্মৃতিরা হানা দিচ্ছে। বুকের ভেতর তীব্র কষ্ট দলা পাকাচ্ছে। তার মনে পড়ে কয়েক বছর আগে হংকং সফরের কথা। মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকিও ছিলেন তার সাথে সেই সফরে। একদিন তিনি মাওলানা ফারুকিকে বলেছিলেন,

‘মাওলানা, আপনার নামে একটা অভিযোগ কানে এসেছে। শুনেছি, আপনি নাকি সিপাহে সাহাবার ফান্ডের টাকা সরিয়ে নিজের জন্য জমি কিনেছেন’

‘হজরত, আমি এমন একজন মানুষ যে প্রতিমূহুর্তে শত্রুর বুলেটের অপেক্ষায় থাকি। আমি জানি না, কোথায়, কখন, কার বুলেটের আঘাতে আমার মৃত্যু হয়। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় ভাবি আজই হয়তো আমার শেষদিন। এখনই হয়তো গুলি চালানো হবে আমার উপর। আপনিই বলুন, এমন একজন মানুষ যে সদা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত সে সিপাহে সাহাবার ফান্ড তসরুফ করে কী করবে? আপনি যে জমির কথা শুনেছেন সেটা আমার এলাকার এক লোকের। সেই লোকের নামও ফারুকি। শত্রুরা এই সুযোগ নিয়ে আমার নামে অপপ্রচার চালাচ্ছে’ মুচকি হেসে জবাব দিয়েছিলেন মাওলানা ফারুকি।

‘হায়, আমি যদি সেদিন তাকে এই কথা না বলতাম। এই বিশ্রি অভিযোগ তাকে না শোনাতাম। মানুষটা চলে গেছেন, এমন মানুষের সন্ধান সহজে মেলে না’ কাঁদতে কাঁদতে ভাবলেন শায়খ মুহাম্মদ মক্কি।


শায়খ মুহাম্মদ মক্কিকে মাওলানা ফারুকি যে কথা বলেছিলেন তা থেকেই তার জীবনের গতিবিধি স্পষ্ট। তিনি নিজেই লিখেছেন, আমাদের জীবনের স্বস্তির দিনগুলি হারিয়ে গেছে, আমরা বেছে নিয়েছি এক কঠিন পথ। এখন একে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে আমাদের দিনগুলি। আমাদের প্রতিটি কাজই এখন জীবনের এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়নের জন্য। আমি এই কন্টকাকীর্ন পথ স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছি। আমাকে কেউ বাধ্য করেনি। আমি এই পথে আসার আগেই মাকে বলে দিয়েছি এই পথে আমাকে শাহাদাতের অলংকার পরতে হবে। কানে বাজবে হাতকড়ির ঝংকার। এই পথের দাবিই এটি। 

মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকির জন্ম ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে, ফয়সালাবাদের সামুন্দরিতে। জামিয়া বাবুল উলুমে তার পড়াশোনা শুরু হয়। শুরু থেকেই একজন মেধাবী ছাত্র হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। মাওলানা ফারুকি নিজের আত্মজীবনিতে লিখেছেন, ছাত্রজীবন ছিল এক আশ্চর্য বসন্তকালের মত। আমি সেই সময়কে এখনো স্মরণ করি। আমি চাই আবার সেই সময় ফিরে আসুক। গভীর রাত পর্যন্ত দরসি ও গায়রে দরসি বইপত্র পাঠ করা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। জমিয়তে তলাবায়ে ইসলামের ব্যস্ততা এবং মাদরাসার পাঠ্যক্রমের পড়াশোনার বাইরেও দিনে গড়ে একশো পৃষ্ঠা পাঠ করা আমার অভ্যাস ছিল। জীবনে কখনো খেলাধুলা করিনি। অবসরেও কোনো কাজে ব্যস্ত থাকাই ছিল আমার অভ্যাস।

মাওলানা ফারুকির এই বিস্তৃত অধ্যয়ন পরবর্তী দিনগুলিতে তার লেখনি ও বক্তৃতার মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে মিশকাতে পড়ার সময় তিনি নবিজির জীবন নিয়ে রাহবার ও রাহনুমা নামে একটি সীরাতগ্রন্থ রচনা করেন। এসময় তিনি তিন মাসে প্রায় একশোটি উর্দু, ফার্সী ও আরবী সীরাতগ্রন্থ অধ্যয়ন করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই লেখালেখি ও বক্তৃতার জগতে তিনি নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে এক সমাবেশে জুলফিকার আলি ভুট্টোর বিরুদ্ধে বক্তব্য দেয়ায় তিনি গ্রেফতার হন। 

অল্পবয়সেই মাওলানা ফারুকি সুবক্তা হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষে তিনি সারাদেশে সফর করে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করতেন। একইসাথে লেখালেখিও অব্যাহত রাখেন। শুরু থেকেই তিনি শিয়া ও বেরেলভিদের বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সতর্ক করতেন। এসব বক্তৃতার কারনে বারবার তাকে প্রশাসনিক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি মোট আটবার কারাবরণ করেন।


ছাত্রজীবন থেকেই মাওলানা ফারুকির সাথে মাওলানা জংভীর সখ্যতা ছিল। দুজনেই ছিলেন সমবয়সী এবং চিন্তার দিক থেকেও কাছাকাছি। সিপাহে সাহাবা প্রতিষ্ঠার আগে দুজনে একসাথেই সারাদেশে বিভিন্ন সমাবেশে অংশগ্রহণ করতেন। মাওলানা জংভী এক বৃহৎ ও মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে সিপাহে সাহাবা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। মাওলানা ফারুকি শুরু থেকেই এর সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। সিপাহে সাহাবা প্রতিষ্ঠার কয়েক মাস পর ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রকাশ্যে সিপাহে সাহাবায় যোগদানের কথা জানান। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি সিপাহে সাহাবার সাথে ছিলেন। সাহাবায়ে কেরামের সম্মান রক্ষায় কাজ করে গেছেন। 

২২ ফেব্রুয়ারী ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে নিজ বাসভবনের সামনে আততায়ীর গুলিতে নিহত হন সিপাহে সাহাবার প্রধান মাওলানা হক নেওয়াজ জংভী। তার ইন্তেকালের পর সিপাহে সাহাবার প্রধান নিযুক্ত হন মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকি। তার সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হন মাওলানা ইসারুল কাসেমি। ১০ জানুয়ারী ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে মাওলানা ইসারুল কাসেমিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তখন তার স্থানে মাওলানা আযম তারিককে নিয়োগ দেয়া হয়।

মাওলানা ফারুকির নেতৃত্বের যুগে সিপাহে সাহাবা এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। একদিকে তিনি বক্তৃতার মাধ্যমে জনসাধারণকে শিয়াদের ভ্রান্তি নিয়ে সতর্ক করছিলেন, আবার লেখনির মাধ্যমে শিক্ষিত সমাজের কাছে শিয়াদের ভুলগুলো তুলে ধরছিলেন। নব্বই দশকের শুরুতে নওয়াজ শরিফের সরকার একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির দায়িত্ব ছিল তারা সকল পক্ষের সাথে কথা বলে শিয়াদের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত জানাবে। এই কমিটির উদ্যোগে পাকিস্তানের ইসলামি সকল ঘরাণাকে নিয়ে তিনটি আলোচনা হয়। মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকিও এই আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা চলাকালে তিনি শিয়াদের বিভিন্ন বইপত্র থেকে তাদের বিকৃতি ও বেয়াদবির দলিল তুলে ধরে ৮৪৪ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত তারিখি দস্তাবেজ নামে একটি নথি পেশ করেন। সকল পক্ষের মতামত পর্যালোচনা শেষে কমিটি সিপাহে সাহাবার অবস্থানকে সমর্থন জানায় এবং শিয়াদের বইপত্র নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করে। কিন্তু প্রশাসন এই ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নেয়নি।


মাওলানা ফারুকি সিপাহে সাহাবার অবকাঠামো নতুন করে ঢেলে সাজান। এ সময় সিপাহে সাহাবার কর্মীসংখ্যা ২০ লাখে উন্নিত হয়। পাকিস্তানের বাইরেও প্রায় ২৭টি দেশে এর শাখা খোলা হয়। মাওলানা ফারুকি বিভিন্ন দেশ সফর করেন। তিনি বাংলাদেশেও এসেছিলেন। বক্তব্য রেখেছিলেন। 

মাওলানা ফারুকির কর্মকান্ডে ইরানি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তৎপর হয়ে উঠে। স্থানীয় শিয়ারাও প্রশাসনের দ্বারস্থ হয়। মাওলানাকে বারবার কারাবরণ করতে হয়। কিন্তু তিনি নিজের অবস্থান থেকে এক বিন্দুও সরে আসেননি। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে ক্ষমতায় এলেন বেনজির ভুট্টো। এসময় প্রশাসন সিপাহে সাহাবার উপর খড়গহস্ত হয়ে উঠে। বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্য ছড়ানোর অভিযোগে সিপাহে সাহাবার নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হতে থাকে। গুপ্তঘাতকের হাতে প্রাণ হারায় অনেকে। অথচ সিপাহে সাহাবার শুধু সাহাবায়ে কেরামের সম্মান রক্ষার কথা বলছিল। শিয়াদের বিকৃত বইপত্র নিষিদ্ধের দাবী জানাচ্ছিল। 

১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের শেষদিকে প্রশাসন সিপাহে সাহাবার উপর চুড়ান্ত আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেয়। সিপাহে সাহাবার ৩০০০ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ২১ নভেম্বর মিয়া শাহনেওয়াজের খুনের মামলায় গ্রেফতার করা হয় মাওলানা আযম তারিক ও মাওলানা জিয়াউর রহমান ফারুকিকে। সিপাহে সাহাবার প্রধান দুই নেতাকে গ্রেফতারের পাশাপাশি সারাদেশে কর্মীদের উপর নির্যাতন চলতে থাকে। মাওলানা ফারুকিকে ৭ দিনের রিমান্ড দেয়া হয়। এরপর তাকে মুলতান কারাগারে পাঠানো হয়। মাওলানা ফারুকি কারাগারেও দাওয়াতি কাজ চালাতে থাকেন। তিনি শেষরাতে জেগে উঠতেন। তাহাজ্জুদ ও তিলাওয়াত শেষে ফজরের সালাত আদায় করতেন। এরপর বন্দীদের নিয়ে দরসে কোরআনের মজলিস করতেন। এ সময় তিনি তাওহিদ, রেসালাত, শানে সাহাবা ইত্যাদী বিষয়ে আলোচনা করতেন। তার এই মজলিসের কারনে কারাগারের পরিবেশ বদলে যায়। এমনকি কয়েকজন অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করে। 

মাওলানা আযম তারিক ও মাওলানা ফারুকিকে যে মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছিল তা ছিল মিথ্যা মামলা। এর সাথে তাদের কোনো সম্পৃক্ততাই ছিল না। ১৯৯৬ সালের ফ্রেব্রুয়ারীতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাওলানা জিয়াউল কাসেমিকে ডেকে পাঠানো হয়। তার মাধ্যমে প্রশাসন একটি সমঝোতা প্রস্তাব করে। প্রস্তাবটি ছিল, সিপাহে সাহাবা তাদের দাবী থেকে সরে আসবে, এবং বেনজির সরকারকে সমর্থন জানাবে। তাহলে সিপাহে সাহাবার নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দেয়া হবে। মাওলানা জিয়াউল কাসেমি কারাগারে এই প্রস্তাব নিয়ে মাওলানা ফারুকির সাথে আলোচনা করেন। মাওলানা ফারুকি সরাসরি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।

ইতিমধ্যে শোনা যায়, ইরান সরকার চাচ্ছে সিপাহে সাহাবার শীর্ষ দুই নেতাকে ফাঁসি দেয়া হোক। এজন্য তারা পাকিস্তান সরকারের সাথে গোপনে লবিং করছে। এই সংবাদ শুনে আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব ডক্টর আল্লামা খালেদ মাহমুদ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি কারাগারে গিয়ে মাওলানা ফারুকির সাথে সাক্ষাত করেন। তিনি বলেন, ইরান সরকার তোমাদেরকে সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছে। এই খুনের মামলাতেই তোমাদেরকে ফাঁসি দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। প্রশাসনের সাথে সমঝোতা করে নেয়াই এখন মঙ্গল।

মাওলানা ফারুকি স্পষ্ট বলে দেন, সরকারের শর্ত মেনে মাথা নিচু করার চেয়ে ফাঁসির মৃত্যু আমাদের অধিক প্রিয়। এটা আমাদের আদর্শিক লড়াই। আমরা এ লড়াই থেকে এক বিন্দু পিছু হটবো না। আমরা কোনো সমঝোতাও করবো না। মাওলানা আযম তারিকও মাওলানা ফারুকিকে সমর্থন জানান। ডক্টর আল্লামা খালেদ মাহমুদ কান্না করতে থাকেন। কিন্তু সিপাহে সাহাবার শীর্ষ দুই নেতা নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

ইতিমধ্যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আলেমদের প্রতিনিধিরা কারাগারে এসে মাওলানা ফারুকির সাথে দেখা করেন। আফগানিস্তান থেকে তালেবানের প্রতিনিধিদল এসে কারাগারে মাওলানা ফারুকির সাথে দেখা করে। তখনো কাবুল তালেবানদের দখলে আসেনি। তালেবানদের প্রতিনিধি আমিরুল মুজাহিদীন মোল্লা উমরের পত্র নিয়ে এসেছিলেন। সেই পত্রে মোল্লা উমর সিপাহে সাহাবা ও এর নেতৃবৃন্দের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ করেছিলেন।


কারাগারে বসে মাওলানা ফারুকি নিজের আত্মজীবনি লেখা শুরু করেন। এই আত্মজীবনিতে তিনি শুধু নিজের কারাবাসের অভিজ্ঞতাগুলোই বর্ননা করেছেন।

১৮ জানুয়ারী, ১৯৯৭।

সেদিন লাহোর সেশন কোর্টে মাওলানা আযম তারিক ও মাওলানা ফারুকির হাজিরা ছিল। কোনো এক বিচিত্র কারণে মাওলানা ফারুকি আদালতে যাওয়ার পূর্বেই নিজের এই আত্মজীবনি লিখে শেষ করেন। এই পান্ডুলিপির শেষ লাইনে তিনি লিখেছিলেন, আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ বেনজির প্রশাসনের সকল পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে গেছে। (এর দুই মাস আগে বেনজির ভুট্টোকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। সম্ভবত এদিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন )। পান্ডুলিপির শেষে তিনি নিজের নাম ও তারিখ লিখেছিলেন। এর কিছুক্ষণ পরেই তিনি মাওলানা আযম তারিকসহ আদালতে যান। সেখানেই বোমার বিষ্ফোরণে তিনি শহীদ হন। এই আত্মজীবনিই ছিল তার লেখা শেষ বই। মৃত্যুর আনুমানিক তিন ঘন্টা আগে তিনি এটি লিখে শেষ করেন। পরে এটি ফের ওহি কইদে কফস নামে প্রকাশিত হয়। মাওলানা ফারুকি বক্তৃতার পাশাপাশি লেখালেখিতেও সক্রিয় ছিলেন। শিয়াদের জবাবে তিনি লিখেছিলেন ৪৫০ পৃষ্ঠায় সমাপ্ত তালিমাতে আলে রাসুল। আশির দশকের শেষদিকে জিয়াউল হকের আমলে কারাগারে বসে লিখেছিলেন, ৫৩৬ পৃষ্ঠার বিশাল গ্রন্থ ‘পয়গামে ইসলাম, আকওয়ামে আলম কে নাম’। এছাড়া তার বক্তব্যগুলো সংকলিত হয়েছে ‘খুতুবাতে ফারুকি’ ও ‘খুতুবাতে মিম্বর ও মেহরাব’ নামে। ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে মাওলানা ফারুকির গভীর পড়াশোনা ছিল। তার বক্তব্য ও লেখায় প্রকাশ পেত। এজন্য তাকে মুওয়াররিখে ইসলাম উপাধিতে ভূষিত করা হয়। 

মাওলানা ফারুকির ইন্তেকালের পর তার স্ত্রীর ইচ্ছা ছিল স্বামীকে নিজ এলাকা সামুন্দরিতে দাফন করা হোক। কিন্তু মাওলানা আযম তারিক বললেন, আমার ইচ্ছা, মাওলানা ফারুকিকে মাওলানা জংভীর কবরের পাশেই দাফন করা হোক। মাওলানা ফারুকির স্ত্রী তা মেনে নিলেন। মাওলানা জংভীর কবরের পাশেই দাফন করা হয় মাওলানা ফারুকিকে। কয়েক বছর পর মাওলানা আযম তারিককেও তাদের কবরের পাশে দাফন করা হয়েছিল।


মাওলানা ফারুকি লিখেছিলেন, যদি সিপাহে সাহাবা ব্যক্তিস্বার্থে পরিচালিত কোনো আন্দোলন হতো তাহলে হক নেওয়াজ জংভীর মৃত্যুর সাথে সাথে তা বন্ধ হয়ে যেত। কিংবা ইসারুল কাসেমির লাশের সাথেই তা দাফন হয়ে যেত। মাওলানা মুখতার আহমদ সিয়াল কিংবা মাওলানা সাইদুর রহমানের শাহাদাতের সাথেই এই গল্প হারিয়ে যেত। কিন্তু না, এই আন্দোলনের বুনিয়াদ রচিত হয়েছে এক সুউচ্চ মিশন ও চিন্তা নিয়ে , তাই লোহার হাতকড়া কিংবা তপ্ত বুলেট এর কর্মিদের দমাতে পারবে না।

নিজের জীবন দিয়ে মাওলানা ফারুকি এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন।